এলেন ধরায় দ্বীনের “নেছার”
ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ। বাংলার মুসলমানদের জন্য সে এক কলংকিত অধ্যায়। একদিন যে মুসলিম জাতি সারা পাকভারতে রাজত্ব করেছিল, তারাই সেদিন কুখ্যাত বৃটিশ শাসক আর তাদের অনুগ্রহপুষ্ট ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত। তাদের দুর্দশার কথা চিন্তা করলেও গা শিউরে উঠে। সামাজিক মর্যাদা বলতে কিছুই ছিলনা। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে তারা ছিল বঞ্চিত। জমিদার বাবুদের কুর্ণিশ দেয়া, তাদের সামনে ভিক্ষুকের মত হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকা, বড়জোর পিঁড়িতে বসার সুযোগ পেয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করা, তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তাদের পদতলে লুটিয়ে পড়া সাধারণ মুসলমানদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছিল। তাদের হীনমন্যতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, হিন্দু বাবুদের জুতোর লাথি খেয়েও তারা আত্মপ্রসাদ লাভ করত। গর্ব করে বলতো- “গেছিলাম কাচারিতে, বড় বাবুর কী সুন্দর জুতা, আহা! জানিস, হেই জুতা দিয়া বাবু আমার পিঠে বসাইয়া দিল দুই ঘাই”। মুসলমানদের জাতীয় অনুভূতি, ধর্মীয় মূল্যবোধ ছিল বিলীন প্রায়। অবিভক্ত বাংলার ইসলামী রেঁনেসা সৃষ্টিকারী ফুরফুরা শরীফের হযরত আবু বকর ছিদ্দিকী (রঃ), মাওলানা কারামত আলী জৌনপুরী (রঃ), হাজী শরীয়ত উল্লাহ (রঃ) প্রমুখ ওলামায়ে হক্কানী এবং কিছু সংখ্যক দ্বীন দরদী কবি সাহিত্যিক আর সাংবাদিকদের আপ্রাণ চেষ্টায় মুসলমানদের মাঝে যদিও কিছু কিছু ধর্মীয় জাগরণ শুরু হয়েছিল, তথাপি মোটামুটিভাবে সারা বাংলা বিশেষ করে এর দক্ষিণাঞ্চল তখনও ছিল অজ্ঞতার তিমির আঁধারে নিমজ্জিত। জ্ঞানের অভাবে আপন তাহজীব-তামাদ্দুন ছেড়ে দিয়ে মুসলমানগণ বরণ করে নিয়েছিল বিধর্মীদের আচার-ব্যবহার, তাদের চালচলন ও পোশাক-পরিচ্ছদ। হিন্দুদের অনুকরণে তারা নামের আগে শ্রী ব্যবহার করত, লুঙ্গির বদলে ধুতি পরত, মাথায় টুপি না দিয়ে টিকি রাখত। এমনকি কোন কোন মুসলমান ঘরের মেয়েরা সিঁথিতে সিঁদুর পর্যন্ত ব্যবহার করত। হিন্দুদের পূজা পার্বণে মুসলমানদের অবাধে অংশগ্রহণ, তিথিলগ্ন ও দিকশূল পালন, দেবদেবীর নামে মানত, ইত্যাদি বহু ইসলাম গর্হিত কাজ ও বিশ্বাস বাংলার ঘরে ঘরে সেদিন সংক্রামক ব্যাধির মত ছড়িয়ে পড়েছিল। দ্বীনী এলেমের চর্চা হয়ে পড়েছিল অত্যন্ত সীমিত। মুসলিম জাতীয় জীবনে নেমে এসেছিল ধর্মীয় চেতনা ও নৈতিক মূল্যবোধের এক চরম বিপর্যয়- সে এক ভয়াবহ সংকট সন্ধিক্ষণ। তার ভাগ্যাকাশে সেদিন দুর্যোগের ঘনঘটা। চারিদিক হতে এক অশুভ রাহুর করাল গ্রাসে ইসলামের নিভু নিভু দীপ শিখাটিও সমাজের বুক থেকে উধাও হওয়ার পথে। চরম ধ্বংসের মুখে বাংলার মুসলিম সমাজ মুক্তি কামনায় সেদিন আর্তনাদ করে উঠেছিল, স্রষ্টার কাছে জানিয়েছিল এক করুণ মিনতিঃ শিরক-বিদয়াত আর অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করে কোথা সে মুজাদ্দিদ- যিনি নূরে মুহাম্মদীর দীপ্ত আলোকে সারা বাংলা উদ্ভাসিত করে দিবেন? কোথা সে বংশীবাদক- যার বাঁশীর সুরে বেজে উঠবে ভুলে যাওয়া সেই হেরা পাহাড়ের সত্য-সুর, মুসলিম প্রাণের প্রতিটি বীণার তারে ঝংকৃত হবে “আলাছতুর” মালিকের পবিত্র নাম? কোথা সে সত্য-সঠিক, দ্বীনের মুরশিদ- যার তাওয়াজ্জু’র বরকতে প্রতিটি মুসলমানের অন্তর নতুন করে সঞ্জীবিত হবে, ছন্দের তালে তালে প্রবাহিত হবে তৌহিদের সোনালী ঝর্ণাধারা, মদীনার সৌরভ ছড়িয়ে মরু সাহারার বুকে নতুন করে রচিত হবে ইশকে রাসূলের সুশোভিত এক বেহেশতি-উদ্যান?
অভ্রভেদী এই আর্তনাদের সুর ধ্বনিত হল বাংলার জমীনে, পাহাড় পর্বতে, বনরাজিতে। প্রকম্পিত হল এর আকাশ বাতাস। উঠে গেল সে আর্তনাদ ঊর্ধ্বে, বহু ঊর্ধ্বে, স্পর্শ করল আল্লাহর পবিত্র আরশ- স্রষ্টার দয়ার্দ্র অন্তর কেঁদে উঠল, ঊর্ধ্ব জগতে ডেকে উঠল রহমতের বান, প্রসারিত হল আলাহর করুণার হাত, নেমে এলেন ধরায় এক দ্বীনের “নেছার”, প্রাণ পেলো বাংলার মৃতপ্রায় মুসলিম সমাজঃ
“ভুবন হইতে উঠিল এ দোয়া, গ্রহমণ্ডল চিড়ি
ছুঁইল আরশ, হইল কবুল মাধুরী আসিবে ফিরি।
বলিলেন খোদা- সৃষ্টি আমার হবে কেন ছারখার?
পাঠাই এবার ছারছীনা ভূঁয়ে সাধক পীর ‘নেছার’।”
==০==